স্টাফ রিপোর্টার | শিল্প ও সাহিত্য, স্বাধীন প্রতিদিন
বাংলা ২৫ শে ফাল্গুন-১৩৫৪, ১১ মার্চ-১৯৪৭ সালে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু খুলনার বয়রায় সম্ভ্রান্ত প্রভাবশালী খালাসী বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর চাচা এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল আলম ও এস এম মোরশেদ আলম ভাসানী ন্যাপের নেতৃস্থানীয় ছিলেন। তাছাড়া তৎকালীন ভাসানী ন্যাপের খুলনা জেলা শাখার সভাপতি প্রতিথযশা এ্যাডভোকেট শহীদ শেখ আঃ জব্বার তাঁদের আত্মীয় হওয়ায় খালাসী বাড়ীর সাথে জব্বার সাহেবের সম্পর্ক ছিল নীবিড় ও ঘনিষ্ট। ফলে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু শৈশব কাল থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত হন। ফলে তিনি স্কুল জীবনেই পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮/৬৯ সালে আইউব খান বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু ছাত্র ইউনিয়নের দৌলতপুর থানা শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৮/৬৯ এর ছাত্র আন্দোলন ছাত্র-শ্রমিক জনতার গণ আন্দোলনে পরিনত হয়। খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে ছাত্র-শ্রমিক সংগ্রাম কমিটিতে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। এ সময় শিল্প কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন দাবীনামা পেশ করে। শ্রমিক, মালিক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ত্রীপক্ষীয় বৈঠকে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু নেতৃত্ব দেন। তার সাথে ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক সরদার আব্দুস সাত্তার, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী জালাল আহম্মেদ প্রমুখ।
শৈশবে ও কৈশরে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু প্রগতিশীল আন্দোলন ও সৃজনশীল আবহাওয়ায় এক গনমুখী চরিত্র লাভে সক্ষম হন। তার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় থেকেই হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু মঞ্চ নাটক, বৈশাখী মেলা, সাহিত্য সম্মেলন ইত্যাদি কাজে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। খুলনা বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগার চত্ত্বরে বৈশাখী মেলা, বয়রা কমিউনিটি সেন্টারে মঞ্চ নাটক ও সাহিত্য সম্মেলন সংগঠিত করেন। ১৯৭৪ সালে বয়রা কমিউনিটি সেন্টারে ২১ শে ফেব্রুয়ারী উদযাপন উপলক্ষে ৩ দিন ব্যাপী আলোচনা সভা ও সাহিত্য সম্মেলন তার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় থেকে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু খুলনাস্থ সাহিত্য সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। মননের বিকাশ ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নতি হওয়া সম্ভব নয় তা তিনি বুঝেছিলেন। তাই ১৯৮৮ সালে 'মননের উৎকর্ষ এবং প্রশান্তির জন্য সাহিত্য' এই সার কথাকে সামনে রেখে বয়রাতে প্রতিষ্ঠা করেন 'খুলনা সাহিত্য সংসদ' যা আজও বর্তমান।
সাহিত্য সংসদে কামরুজ্জামান স্মৃতি লাইব্রেরী, সুবিধা বঞ্চিত মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষাদান প্রকল্প 'দুখু মিঞার পাঠশালা', নার্সারী মালিক সমিতি ইত্যাদি গড়ে তোলেন। তিনি আজীবন নার্সারী মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে নার্সারি শিল্প হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ফুলতলায় 'রবীন্দ্র কমপ্লেক্স' এর সাথে তিনি শুরু থেকে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। তিনি স্পন্দন সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেন। সাপ্তাহিক 'গোলপাতা' ও সাপ্তাহিক 'বহুবচন' এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি। হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু খুলনা বেতারে নাট্যকার হিসাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ সালে একাঙ্কিকায় জেলা পর্যায়ে শীর্ষ স্থান অধিকার করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদফতর কর্তৃক একুশে সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
সিটি কর্পোরেশনের প্রত্যেকটা ওয়ার্ড-এ ওয়ার্ড ভিত্তিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা তার প্রস্তাব ছিল।
তিনি ২০০৩ সালে সাহিত্য সংসদে কামরুজ্জামান স্মৃতি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০৩ সালেই সাহিত্য সংসদ চত্বরে তিন দিন ব্যাপী বিজয় দিবস উদ্যাপন ও বই মেলা, ২০০৪ সালে ১লা বৈশাখে বৈশাখী মেলা, বইমেলা ও প্রকাশনা উৎসব তার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
২০০৫ সালে ১লা বৈশাখে বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগার চত্বরে বৈশাখী মেলার সাথে ৫ দিনের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ অনুষ্ঠানের আহবায়ক ছিলেন প্রয়াত লাইব্রেরিয়ান হাসনুজ্জমান ও সদস্য সচিব ছিলেন জিয়া হাসান সুমন। হারুন-অর-রশীদ বাচ্চুর নেতৃত্বে ২০০৬ সালে বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগার চত্বরে "একুশে বইমেলা-খুলনা" অনুষ্ঠিত হয়। আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির ও সদস্য সচিব ছিলেন প্রয়াত লাইব্রেরিয়ান হাসানুজ্জামান। ২০০৭ সালে বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগার চত্বরে ২১শে বই মেলা- খুলনা অনুষ্ঠিত হয় আহবায়ক ছিলেন ভাষা সৈনিক সমীর আহম্মেদ, সদস্য সচিব ছিলেন শরিফুল ইসলাম সেলিম। ২০০৮ ও ২০০৯ সালে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চুর নেতৃত্বে বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগার প্রাঙ্গনে ২১শে বইমেলা-খুলনা অনুষ্ঠিত হয়। এ দু' বছর আহবায়ক ছিলেন ভাষা সৈনিক সমীর আহম্মেদ ও সদস্য সচিব ছিলেন শরিফুল ইসলাম সেলিম। হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু বরাবর চাইতেন একুশে বইমেলা খুলনা সরকারী তত্ত্বাবধানে থেকেই সম্পন্ন হোক। তাই বইমেলার সকল কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি এই প্রচেষ্টাও চালিয়ে যান। অবশেষে তিনি সফল হন এবং সরকারের পক্ষে খুলনা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ২০১০ সাল থেকে অদ্যবধী একুশে বইমেলা-খুলনা ভিাগীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হারুন-অর-রশীদ নিজের নামের প্রচার ও নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। সকল কাজে নিজে সর্বোচ্চ শ্রম এবং নেতৃত্ব দিলেও কাগজে কলমে অন্য যোগ্য ব্যক্তিদের আহবায়ক ও সদস্য সচিবের দায়িত্ব দিতেন। অনুষ্ঠান চলাকালে আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও প্যান্ডেলে আগত গুনীজনদেরকে মঞ্চে ডেকে তুলতেন ও সম্মান প্রদর্শন করতেন। নিজ অর্থ ও সংগৃহীত অর্থ দ্বারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও বইমেলার খরচ সম্পাদন করতেন।
হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু বেশ কিছু কবিতা ও ছোট গল্প রচনা করেন। কিন্তু সংরক্ষনের অভাবে তা হারিয়ে গেছে। তাঁর জীবনধর্মী প্রহসনমূলক একটা গল্পের নাম ছিল 'লাশের মহাজন'।
রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও অঞ্চলগত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু গুনীজনকে যোগ্য সম্মান ও নেতৃত্ব প্রদান করতেন। তার দ্বারা পরিচালিত অনুষ্ঠানে ব্যাপক সুধী ও গুনীজনকে সম্পৃক্ত করতে পারতেন। এর ফলে ২১ শে বইমেলা-খুলনা সকল মানুষের প্রণের মেলা হিসেবে পরিণত হয়েছে। হারুন-অর-রশীদ বাচ্চুর দূরদৃষ্টি ও উদার নেতৃত্বের কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। খুলনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ লেখক, সাহিত্যিক, সামাজিক নেতৃত্ব প্রদানকারী সকলের মনোযোগ ও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছেন হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু। তাই তিনি শুধু মাত্র বয়রার সাহিত্য সংসদের নেতা নন বরং খুলনার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতাতে পরিণত হয়ে আমাদের সকলের প্রেরনার উৎসে পরিণত হয়েছেন। হারুন-অর-রশীদের নশ্বর দেহটি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার মানবিক কীর্তি '২১শে বইমেলা খুলনা' অবিনশ্বর প্রেরণার উৎস হয়ে তার মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন হারুন-অর-রশীদ বাচ্চু।
২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণে ৩১ অক্টোবর ২০২৫ বিকাল ৪.০০-টায় আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর আব্দুল মান্নান, ডঃ গোলাম সাকলাইন, কবি দেবদাস মিস্ত্রি, কবি ও নজরুল গবেষক সৈয়দ আলী হাকিম, কবি কামরুল হাসান মৃধা, ডাক বিভাগীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ, দৈনিক মানব জমিন পত্রিকার খুলনা ব্যুরো প্রধান ও সাংবাদিক নেতা রাশেদুল ইসলাম, খুলনা কবি-সাহিত্যিক ফোরামের সদস্য সচিব কবি আজাদুল হক আজাদ, সাহিত্য সংসদের যুগ্ম সম্পাদক ও মরহুম হারুন অর রশিদ বাচ্চুর সন্তান এস এম বদরুল আলম রয়েল এবং সভাপতি সাইফুল ইসলাম মল্লিক এর সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মোড়ল।
বক্তারা মরুহুম হারুনুর রশিদ বাচ্চুর সাহিত্য ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং আলোচনা শেষে তাঁর মাগফেরাত কামনায় দোয়া পরিচালনা করেন কবি সৈয়দ আলী হাকিম।
📰 আরও খবর জানতে ভিজিট করুন:
www.shadinpratidin.com
💬 মতামত দিন | 🔁 বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন
মন্তব্য করুন